ডিমেনশিয়া কি?

মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার ফলাফল রূপে ডিমেনশিয়ার উদ্ভব ঘটে। বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের ক্রমাবনতিশীল প্রক্রিয়ার দ্বারা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে স্মৃতি বিকৃতি ঘটলে সেটাকে ডিমেনশিয়া নামে অভিহিত করা হয়।ডিমেনশিয়ায় স্মরণশক্তি, চিন্তাশক্তি, আচরণ এবং অনুভূতি আক্রান্ত হয়। ডিমেনশিয়া সমাজের সকল গ্রুপকেই সমানে আক্রমণ করে। এটা সমাজের কোন শ্রেণী, জেন্ডার, জাতিগত নৃ-গোষ্ঠী অথবা ভৌগলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে না। যদিও ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বয়োবৃদ্ধদের মধ্যেই অধিক কিন্তু কমবয়সি ব্যক্তিরাও এতে আক্রান্ত হতে পারেন।

ডিমেনশিয়ার কারণ কি?

বেশ কিছু রোগের কারণে মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘটে যা পরিশেষে স্নায়ুকোষ (নিউরন) নষ্ট করে ডিমেনশিয়ার উদ্ভব ঘটায়। ডিমেনশিয়ার সংগে সংশ্লিষ্ট রোগের মধ্যে রয়েছে-
আলঝেইমারস রোগ

ডিমেনশিয়ার সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে এই রোগটি যা শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগের ক্ষেত্রেই ডিমেনশিয়ার জন্য দায়ী। এটা মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষ ও স্নায়ুতন্ত্রকে ধ্বংস করে তথ্য প্রবাহের মেসেজবাহী ট্রান্সমিটারের প্রবাহকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বিশেষত: স্মৃতিগ্রহণ স য় ও রক্ষণ কাজে সংশ্লিষ্ট স্নায়ুকোষ সমূহ এ রোগে অধিক আক্রান্ত হয়।

ভাসকুলার ডিমেনশিয়া

মস্তিষ্ক একটি অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহকারী ভেসেলস নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল। মস্তিস্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিস্কের কোষগুলো মারা যায় এবং এর দ্বারা ভাসকুলার ডিমেনশিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। হঠাৎ ডিমেনশিয়ার লক্ষণ শুরু হয় কিংবা কোন একটা বড় স্ট্রোকের পর থেকে কিংবা ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া একগুচ্ছ ছোট ছোট স্ট্রোকের ফলে ডিমেনশিয়ার লক্ষণ অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে দেখা দিতে পারে।

লিউ বডি জনিত ডিমেনশিয়া

এজাতীয় ডিমেনশিয়ায় স্নায়ুকোষের ভিতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোলাকার বস্তু (লিউ বডি) জমে বিধায় একে লিউ বডি ডিমেনশিয়া বলা হয়।ব্রেনে এ গুলির উপস্থিতি মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষয়রোগ (ডিজেনারেশন) সৃষ্টি করে।স্মৃতিশক্তি, একাগ্রতা এবং ভাষা-দক্ষতা এতে নষ্ট হয়ে যায়।

ফ্রন্টো টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া (এতে পিকস রোগও অন্তর্ভুক্ত)

ফ্রন্টো-টেম্পোরাল ডিমেনশিয়ায় সাধারণত মস্তিষ্কের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ব্যক্তিত্ব এবং আচরণগত দিকগুলি এতে অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।সে তুলনায় স্মৃতিশক্তির বিপর্যয় অপেক্ষাকৃত কম থাকে।

ডিমেনশিয়ার বিরল কারণসমূহ

ডিমেনশিয়া হওয়ার আরো অনেক বিরল কারণ রয়েছে। এগুলো হলো প্রোগ্রেসিভ সুপ্রানিউক্লিয়ার পল্সি , করসাকোফস্ সিনড্রম, বিন্সউইনগার রোগ, এইচ আই ভি এবং ক্রুজফিল্ড-জ্যাকব রোগ (CJD) ইত্যাদি।কারো মাল্টিপল এসক্লেরোসিস, মোটর নিউরন রোগ, পারকিনসন্স রোগ এবং হানটিংটন্স ডিজিজ থাকলে তাদেরও ডিমেনশিয়া হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে।

ডিমেনশিয়ার উপসর্গগুলো কি কি?

ডিমেনশিয়া একটি ক্রমাবনতিশীল প্রক্রিয়া। এর অর্থ হল সময় বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের গঠন এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়া অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির স্মরণশক্তি, উপলব্ধি, প্রকাশ ক্ষমতা এবং যুক্তি বুদ্ধি ক্রমেই হ্রাস পায়।ডিমেনশিয়া কত দ্রæত হারে বাড়বে তা অনেকটাই ব্যক্তি নির্ভর। প্রতিটি ব্যক্তিই অভিনব এবং তাদের স্বতন্ত্র ভাবে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত হয় ।

কার মধ্যে কিভাবে ডিমেনশিয়ার উপসর্গ দেখা দিবে তা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যার মধ্যে আছে শারীরিক গঠনবিন্যাস, মানসিক অবস্থা এবং অন্যান্য প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার উপর। পরস্পর সমন্বিত কতকগুলো স্তরে ডিমেনশিয়ার উপসর্গগুলো প্রকটিত হয় এভাবে বিবেচনা করলে রোগটি উপলব্ধি করা সহজ বটে কিন্তু একথা অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ যে এটা শুধু রোগের গতিবিধির একটি অস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে মাত্র এবং সবার ক্ষেত্রে সব উপসর্গ প্রকাশ পায় না।

কিছু উপসর্গ রোগের যে কোন স্তরে দেখা দিতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে রোগের শেষ স্তরে যে লক্ষণ তালিকাবদ্ধ আছে সেটা মধ্যম স্তরে দেখা দিতে পারে। এছাড়া পরিচর্যাকারীদের সচেতন থাকা উচিত যে, রোগটির সকল স্তরে স্বল্প সময়ে সুস্থ্য অবস্থার ন্যায় স্বাভাবিক অবস্থা দেখা দিতে পারে।

নিচের রূপরেখা গুলো আলঝেইমারস রোগের প্রারম্ভিক, মধ্যম এবং শেষ স্তরে চরিত্রগত লক্ষণ এবং সংক্ষিপ্তভাবে অন্যান্য ডিমেনশিয়ার বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্দেশ করে।

আলঝেইমারস রোগ

প্রারম্ভিক স্তর ( Early stage )

প্রারম্ভিক স্তরটি পেশাজীবি, আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই উপেক্ষা করেন, এবং ভুলক্রমে এটাকে “বার্ধক্য জনিত” অথবা বয়োবৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক অংশ হিসাবে উল্লেখ করতে চান।

যেহেতু রোগটির সূত্রপাত ঘটে অত্যন্ত ধীরগতিতে, সেহেতু প্রকৃতপক্ষে ঠিক কোন সময়ে আলঝেইমারস রোগটি আরম্ভ হল তা সনাক্ত করা খুবই কঠিন। তাঁর যা হতে পারেঃ

  • কথা বলবার মধ্যে শব্দচয়নে অসুবিধা দেখা যায়।
  • উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হ্রাস- বিশেষ করে স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি ঠিক থাকে না।
  • সময় জ্ঞান থাকে না।
  • পরিচিত জায়গাগুলো চিনতে পারে না।
  • সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা বোধ করে।
  • উদ্যোম ও প্রেরণার অভাব দেখা যায়।
  • বিষন্নতা ও বৈরী আচরণ প্রকাশ পায়।
  • শখের বিষয়ে কিংবা সামাজিক কর্মকান্ডে আগ্রহ না থাকা।

মধ্যবর্তী স্তর  Middle stage)

ক্রমাগত রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সমস্যাগুলো আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয় এবং রোগীকে সংকীর্ণ গন্ডিতে আবদ্ধ করে। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন দুর্বিসহ হতে থাকে এবং

  • সহসাই সবকিছু ভুলে যেতে পারে-বিশেষ করে কোন সাম্প্রতিক ঘটনা ও পরিচিত ব্যক্তির নাম।
  • সমস্যা তার জীবনে সঙ্গী হয়ে যায়।
  • রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা, গোসল বা ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে না।
  • প্রচন্ডভাবে পরনির্ভর হতে পারে।
  • ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি যেমন বাথরুম যাওয়া, ধৌত করা এবং পোশাক পরিধানে অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হয়।
  • কথা বলতে চরম অসুবিধা হয়।
  • উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরাফিরা এবং অন্যান্য আচরণগত অসামঞ্জস্য দেখা দেয়।
  • বাড়ীতে এবং কমিউনিটিতে দিশেহারা হয়ে যায়।
  • কাল্পনিক জিনিস শ্রবণ বা দেখতে পাওয়া সংক্রান্ত অসুবিধা দেখা দিতে পারে।

শেষ স্তর ( Late stage)

এটা হলো সম্পুর্ণভাবে পরনির্ভরশীলতা এবং নিষ্ক্রিয়তার পর্যায়। স্মৃতি ভ্রষ্টতা অতীব প্রকট হয় এবং রোগের নির্ণায়ক চরিত্রের দিক আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ স্তরে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে।

  • খাবার খেতে অসুবিধা হয়।
  • আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পরিচিত জিনিস চিনতে পারে না।
  • যে কোন বিষয় বুঝতে এবং ঘটনাদি ব্যাখ্যা করতে অসুবিধা হয়।
  • নিজ বাড়িতেই চলাফেরার পথ খুঁজে পায় না/হারিয়ে যায়।
  • হাঁটতে অসুবিধা হয়।
  • মল- মুত্র ত্যাগের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
  • জনসমাজে অসংযত আচরণ করে।
  • হুইল চেয়ার বা বিছানায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

ভাসকুলার ডিমেনশিয়া (Vascular dementia)

ভাসকুলার ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের বেলায় কিছু কিছু উপসগর্  দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীল থাকে এবং তারপর একটা সময় আর একটি স্ট্রোকের ফলে হঠাৎ সেগুলোর অবনতি ঘটে।  আলঝেইমারস রোগে যে ধীরগতির ক্রমাবনতি দেখা যায় যা ঠিক এর উল্টো। তবে কখনো কখনো একজন ব্যক্তি আলঝেইমারস নাকি ভাসকুলার ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন তা নিরূপণ করা কঠিন হয়ে পরে। কেননা যে কেউ একসঙ্গে দুটি রোগেই আক্রান্ত হতে পারেন। 

ফ্রন্টো-টেম্পারাল লোব ডিমেনশিয়া (পিকস রোগ সহ)

Fronto-temporal lobe dementia (including Pick’s disease)

প্রাথমিক অবস্থায় স্মৃতিশক্তি স্বাভাবিক থাকতে পারে। তবে অন্যান্য পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ আক্রান্ত  ব্যক্তিকে স্বার্থপর এবং অনুভূতিহীন বলে মনে হতে পারে। তারা রূঢ়ভাবে আচরণ করতে পারে বা খুব সহজেই উন্মাদগ্রস্থ  হয়ে পড়তে পারে। অন্যান্য উপসর্গ যেমন শালীনতা নষ্ট, সঙ্কীর্ণ মনোভাব এবং মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি অধিক আগ্রহ থাকতে পারে। শেষ পর্যায়ে তাদের মধ্যেও আলঝেইমারস রোগের অনুরূপ উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে।      

লিউ বডি জনিত ডিমেনশিয়া ((Dementia with Lewy bodies)

এসব রোগীর শতকরা ৫০ ভাগ বা তারও বেশি ক্ষেত্রে চলাচলে ধীরগতি, কাঠিন্যভাব এবং কাঁপুনি ইত্যাদি পারকিনসন্স রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। তারা সহজে কোন বস্তুর দূরত্ব নির্ণয় করতে পারে না এবং হঠাৎ মাটিতে পড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। এসব ব্যক্তিরা সাধারণত দৃষ্টিভ্রমে (হ্যালুসিনেশনে) ভোগে। এ রোগের অন্যতম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হলো আক্রান্ত ব্যক্তির কর্মক্ষমতায় প্রায়শঃ হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে যা পরিচর্যাকারীকে গোলক ধাঁধায় ফেলে দেয়।